ডা. বুলবুল ইসলাম 'ঈসা

কনসালটেন্ট হোমিওপ্যাথ

ডি.এইচ.এম.এস (বি.এইচ.বি)
ফাউন্ডার ডিরেক্টর- গ্লোবাল হোমিও সেন্টার

ওজন বাড়ানোর এবং ওজন কমানোর সহজ ও সঠিক উপায়

যা যা থাকছে-

শুরুতে জানব-

শরীরের ওজনের মেইন ফ্যাক্ট কী?

আমরা ত মাছ-মাংস, ডিম-দুধ, ফল-মূল অনেক কিছুই খাই, কিন্তু আমাদের শরীর প্রকৃতপক্ষে খায় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেলস, এবং পানি। এগুলোকে এক বাক্যে বলা হয় নিউট্রিশানস বা পুষ্টি উপাদান। এ সমস্ত পুষ্টি উপাদান গুলোর একেকটার এক এক ধরনের কাজ; কেউবা পেশী গঠন করে, কেউবা হাড় গঠন করে কেউবা শক্তি যোগায় আর কেউবা শরীরের ক্ষয় পূরণ করে।

 

তাহলে সারকথা হচ্ছে এই সমস্ত পুষ্টি উপাদান একত্রিত হয়ে বা জমা হয়ে আমাদের শরীর গঠন করে। অর্থাৎ এই সমস্ত পুষ্টি উপাদান গুলোই জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অস্থি-মজ্জা, মাংস, চর্বি  প্রভৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে অবস্থান করে। এবং পদার্থের যেহেতু ওজন এবং আয়তন আছে,  সেহেতু এই সকল পুষ্টি উপাদান জাতীয় পদার্থ গুলোর ওজন এবং আয়তনের দ্বারাই আমাদের শরীর ওজন এবং আয়তনে সমৃদ্ধ হয়।

এখন-

এই সমস্ত পুষ্টি উপাদান আমরা কোথায় পাব?

ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই! আমরা যে ভাত-পানি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ প্রভৃতি খেয়ে থাকি, সে সসব মূলত এই সমস্ত পুষ্টি উপাদান নিয়েই গঠিত। 

এখন যদি প্রশ্ন করি-

ওজন বাড়ানোর উপায় কী?

পারবেন তো উত্তর দিতে? হ্যাঁ! সোজা উত্তর- আমরা যদি বেশি করে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাই,  আর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করি তাহলে শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সমস্ত  খাদ্য উপাদান গুলোই অস্থি-মজ্জা, মাংস, চর্বি  প্রভৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে অবস্থান করবে এবং আমাদের ওজন বাড়বে।

আবার যদি প্রশ্ন করি

ওজন না বাড়ার কারণ কী?

পারবেন তো তার উত্তর দিতে? জানি পারবেন, কারণ এর উত্তরও ওই একই। আমরা যদি এই সমস্ত নিউট্রিশন বা পুষ্টি উপাদান গুলো গ্রহণ করা বর্জন করি বা কমিয়ে দিই তাহলে আমাদের শরীর সেগুলোকে সঞ্চয় করতে পারবেনা ফলে ওজনও বাড়বে না।

তাহলে-

ওজন কমার কারণ কী?

খাবার খেলে ওজন বাড়ে, না খেলে বাড়ে না, সেটা তো বুঝলাম কিন্তু তাহলে ওজন কমে কেন? আমাদের শরীরে যত  নিউট্রিশন বা পুষ্টি উপাদান জমা হয় তার অনেকগুলোই শরীরের সঞ্চয় হিসেবে জমা হয় যা পরবর্তীতে শরীর তার শক্তি উৎপাদনে ব্যয় করে। এ কারণেই দেখা যাচ্ছে  বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা অনেক সময়  কয়েক দিন পর্যন্ত না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারি।

 

তাহলে আমরা যখন নিউট্রিশন বা পুষ্টি উপাদান গুলো গ্রহণ করা বন্ধ করে দিচ্ছি বা কমিয়ে দিচ্ছি অর্থাৎ যতটা প্রয়োজন তার থেকে কম নিচ্ছি তখন আমাদের শরীর তার জমা থেকে খরচ করা শুরু করছে, ফলে তখন শরীরের সঞ্চয় কমে যাচ্ছে অর্থাৎ ওজন ও আয়তন কমে যাচ্ছে।

আবার দেখা যায় দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং অন্যান্য শরীর বৃত্তীয় ব্যাপারে আমাদের শরীর প্রতিনিয়ত ক্ষয় হতে থাকে। সেই ক্ষয় আমরা আমাদের গ্রহণকৃত পুষ্টি উপাদান থেকেই পূরণ করে থাকি। কাজেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেওয়া মানেই ওজন কমে যাওয়া।

এখন কথা হচ্ছে খাবার তো রাম শ্যাম যদু মধু সকলেই খাচ্ছে, এমনকি অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তারা একই পরিবারে একই বাবুর্চির রান্না করা খাবার একই হাঁড়ি-কড়াই থেকে খেয়ে কেউ হচ্ছে পেল্লাই মোটা, কেউবা মাঝারি, কেউবা আর একটু কম, আবার কেউবা একেবারেই রোগা-পোটকা! এর কারণ কী?

এখানে কয়েকটা ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন-

১। কেউ যত পরিমাণে পুষ্টি উৎপাদন গ্রহণ করছে তার  প্রায় সবটুকুই সে শরীরের ক্ষয় পূরণ এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে শক্তি হিসেবে ব্যয় করছে অর্থাৎ তার অধিকৃত খাদ্য তার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছে ফলে তার ওজন বাড়ছেও না, কমছেও না।

 

২। আবার কেউ হয়ত শরীরের ক্ষয় পূরণ এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে শক্তি হিসেবে ব্যয় করার জন্য যত পরিমাণে পুষ্টি উৎপাদন গ্রহণ করা দরকার তারচে’ কম পরিমানে গ্রহণ করছেন। তার ওজন ত বাড়ছেই না বরং দিন দিন তার ওজন কমছে। এখানে জমা এবং খরচের হিসাবের পার্থক্য যত বেশী হবে তার ওজন তত দ্রুত কমবে।

 

৩। আর কেউ হয়ত যত পরিমাণে পুষ্টি উৎপাদন গ্রহণ করছে তার সবটুকু সে দৈনন্দিন কাজকর্মে শক্তি হিসেবে ব্যয় করছে না অর্থাৎ তার অধিকৃত খাদ্য পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না, ফলে অতিরিক্ত নিউট্রিশান জমা হয়ে তার ওজন বাড়ছে। আর এখানে জমা এবং খরচের হিসাবের পার্থক্য যত বেশী হবে তার ওজন তত দ্রুত বাড়বে।

এসব ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরীরের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমে ত্রুটি, শরীরে বিদ্যমান নানান রোগ, কিছু কিছু উগ্র ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাব ইত্যাদি শরীরের ওজনে তারতম্য ঘটাতে ভুমিকা রাখে।



এখন যারা ওজন বাড়াতে চান, তাদের দেখতে হবে যে তারা উপরের আলোচনার সকল ক্রাইটেরিয়া মেইনটেইন করে পর্যাপ্ত পরিমানে নিউট্রিশানস শরীরে ইনপুট করছেন কিনা বা সোজা কথায় খাচ্ছেন কিন। যদি দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং শরীরের ক্ষয় পূরণ করার মত পর্যাপ্ত পরিমানে পুষ্টি উপাদানের চেয়ে অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান গ্রহনের পরেও কারো ওজন না বাড়ে তবে বুঝে নিতে হবে তাদের শরীরের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমে কোন গন্ডগোল আছে অথবা তারা কোন আভ্যন্তরীণ রোগে ভুগছেন।  

তাহলে সেক্ষাত্রে করনীয় কী? সেক্ষেত্রে কেবল এবং কেবলমাত্র একটাই করনীয়, আর তা হল প্রপার চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্ত হওয়া।

এখন কথা হচ্ছে-

ঔষধ খেয়ে ওজন বাড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত?

শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহনের পরেও ওজন না বাড়লে ধরে নিতে হবে শরীরে ত্রুটি বা রোগ আছে। সেক্ষেত্রে সেই রোগের চিকিৎসা না করে বিভিন্ন ভিটামিন, সিরাপ, ইনজেকশান প্রভৃতির মাধ্যমে ওজন বাড়ানো কি কখনো যুক্তিযুক্ত হতে পারে? এটা কি কোনভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ? 

মোটেই না। কলসির ছিদ্র বন্ধ না করে তাতে হাই পাওয়ারের পাম্প দিয়ে পানি হয়ত ভরা যায়, কিন্তু তা কতক্ষণ? পাম্প বন্ধ করলেই পানি কমা শুরু করবে। এমনকি হাই পাওয়ারের পাম্পের পানির প্রেশারের কারণে কলসির ছিদ্র হয়ত আগের চেয়ে বড়ই হয়ে যাবে, আর তাতে করে পরবর্তীতে কলসি হয়ত আরো দ্রুতই খালি হতে থাকবে, এবং শুন্যে পৌঁছে যাবে।


এমন অনেক রোগীই আমি আমার প্রকটিস লাইফে দেখেছি যারা ওজন বাড়ানোর জন্য ঔষধ খেয়ে পরে ঔষধ বন্ধ করে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে।

কাজেই, এমন ক্ষেত্রে এইসব ওজন বাড়ানোর ঔষধ কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আগে একজন নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিজের রোগ  সারান এবং তারপর প্রয়োজনীয় নিউট্রিশন গ্রহণ করুন।  আশা করি ওজন বাড়াতে আর কোন ঝামেলা হবে না।

সর্বশেষ তাহলে-

ওজন কমানোর উপায় কী?

উপরের আর্টিকেলটা আপনারা যারা মনোযোগ সহকারে পড়েছেন আশা করি এ প্রশ্নের উত্তর এখন আপনারা প্রত্যেকেই দিতে পারবেন। 

খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনুন এবং কায়িক পরিশ্রম অথবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরিয়ে ফেলুন; এটাই ওজন কমানোর একমাত্র সোজাসাপ্টা উপায়।

তাহলে-

ঔষধ খেয়ে ওজন কমানো কি আদৌও যুক্তিযুক্ত?

অনেকে ওজন কমানোর জন্যও ঔষধ খোঁজ করে, কিন্তু সেটা মোটেও ঠিক নয়। স্বাভবিক নিয়মের বাইরে গিয়ে আপনি যদি কিছু করার চেষ্টা করেন তবে সেটা সাধারন ভাবেই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

একটা কথা চিন্তা করুন, আপনি আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে খাবারই খাবেন সেটা স্বাভাবিক নিয়মেই আপনার শরীরে স্টোর হবে এবং ওজন বাড়াবে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই নিয়ম। এভাবেই আপনার শরীরের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেম গঠিত।
এখন আপনি আপনার খাবার না কমিয়ে, স্বাভাবিকভাবে কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত সঞ্চয় খরচ না করে, যদি কোন উগ্র ঔষধের মাধ্যমে সেগুলোকে শর্টকাটে বিনাশ করতে চান, তাহলে কি সেটা শরীরের স্বাভাবিক ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের সাথে অসংগতিপূর্ণ নয়? সেটা কি আপনার স্বাভাবিক সিস্টেমটাকে বিকৃত করে দিচ্ছে না? ধ্বংস করে দিচ্ছে না? 

হয়ত দেখা যাচ্ছে এই সমস্ত ঔষধ খেয়ে আপনার ওজন সাময়িকভাবে কমছে, কিন্তু আপনি কি ভবিষ্যতের কথা ভাববেন না? আপনার সেই বিকৃত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত মেটাবলিক সিস্টেম দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে কি আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন?

কাজেই নো শটকার্ট! স্বাভাবিক বাস্তবতা মানুন এবং উপরে যেভাবে বলেছি ওভাবেই ট্রাই করুন। সুস্থ থাকুন, স্বাভাবিক থাকুন এবং প্রাণবন্ত থাকুন। 

কিন্তু যদি স্বাভাবিক প্রচেষ্টায় আপনার ওজন না কমে, বা কোন বিশেষ অসুবিধা বোধ করেন, তবে আগের মতই বুঝতে হবে শরীরে কোন গন্ডগোল বা অসুখ রয়েছে। তাহলে তখন কী করতে হবে? ওজন কমানোর ঔষধ নয়, বরং সেই সমস্যা বা রোগটাকে সারানোর জন্য চিকিৎসা করাতে হবে। আর তারপর সুস্থ্য হয়ে আবার সেই স্বাভাবিক নিয়মেই ওজন কমাতে হবে। ওটাই একমাত্র পথ।

…আজ আর নয়, আর একদিন কথা হবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp