…আজ বলব ডায়াবেটিস নিয়ে।
আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত লেখাগুলো জুনিয়র চিকিৎসক এবং মেডিকেল স্টুডেন্টদের শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে লেখার কারণে অনেক মেডিকেল টার্ম ব্যবহার হয়। অন্যান্য পাঠকরা একটু কষ্ট করে পড়ে নেবেন এটাই প্রত্যাশা। কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে প্রশ্ন করতে দ্বিধা না করার অনুরোধ।
ডায়াবেটিস (Diabetes) কাকে বলে?
ডায়াবেটিস হচ্ছে এমন এক অসুখ যেখানে শরীরের রক্তে সুগার বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়।
অনেক মানুষকে দেখি চিনি ছাড়াই চা খেতে। তারা হয়ত ভাবতে পারে এই এক চামচ চিনি পরিহার করা মানেই ডায়াবেটিস থেকে দূরে থাকা।
কিন্তু আসলে কি তাই? না।
আমরা খাবার হিসেবে যা খাই তার একটা অংশ আমাদের Small intestine বা ক্ষুদ্রান্ত্রে গিয়ে ভেঙে Sugar এ পরিনত হয়। এর আর এক নাম Glucose.
এই সুগার বা গ্লুকোজ তখন Small intestine কর্তৃক শোষিত হয়ে রক্তে নির্গত হয়। কাজেই তখন রক্তে সুগার লেভেল বেড়ে যায়।
এই সুগার স্বাভাবিকভাবে এবং সাধারণভাবে আমাদের শত্রু ত নয়ই বরং নিতান্ত অত্যাবশকীয় উপাদান। কেননা একে আমাদের শরীরের Cell গুলো শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করে, যা দিয়ে আমরা আমাদেরকে সচল রাখি।
কিন্তু এই সুগার আমাদের Cell গুলো সরাসরি গ্রহণ করতে পারেনা। কেননা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের cell গুলো বন্ধ বস্থায় থাকে।
এই বন্ধ Cell গুলো খুলে তাতে সুগার বা গ্লুকোজ প্রবেশ করাতে আর একটা হরমোন দরকার হয়, তার নাম Insulin.
Insulin কোষের receptor এ গিয়ে একধরনের চাবির মত কাজ করে। তখন আমাদের Cell গুলো ওপেন হয় এবং সুগার তাতে প্রবেশ করে।
তো কোথায় পাওয়া যায় এই Insulin?
এই ইনসুলিন তৈরি হয় আমাদের Pancreas বা অগ্নাশয়ে।
এই অগ্নাশয়ের কার্যক্রমও নিয়ন্ত্রিত হয় আর এক হরমোন এর মাধ্যমে, যার নাম Glucogon-like-peptide-1 বা GLP-1.
ঘটনাটা এমন, আমরা খাবার গ্রহনের পর তার একটা অংশ যখন intestine এ এসে যখন ভেঙে সুগারে পরিণত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে, তখন একই সময়ে আমাদের Intestine এর endocrine cell- GLP-1 হরমন নিঃসরণ করে।
এই হরমোন আমাদের Pancreas এর Beta cell কে প্রয়োজনীয় Insulin উৎপাদন করতে উদ্দীপিত করে এবং Alfa cell কে glucogon হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়।
Pancreas এর Alfa cell এ উৎপন্ন হওয়া এই Glucogon আমাদের Liver কে জমা থাকা গ্লুকোজ নিঃসরণ করতে উদ্দীপিত করে। এটা ঘটে আমরা যখন দীর্ঘ সময়, যেমন রাতে, উপবাস কিংবা দূর্যোগে অনাহারে থাকি তখন শরীরের প্রয়োজনীয় সুগার বা গ্লুকোজের লেভেল ঠিক রাখার জন্য।
যাইহোক, তাহলে GLP-1 একদিকে Insulin উৎপাদনে সাহায্য করছে যাতে রক্তের সুগার সেই Insulin এর সাহায্যে শরীরের কোষে প্রবেশ করে আর অন্যদিকে Glucogon উৎপাদনে বাঁধা দিচ্ছে যাতে সেই glucogon লিভারের সঞ্চিত সুগার রক্তে নির্গত হতে নির্দেশ না দিতে পারে।
এভাবেই আমাদের রক্তের তথা শরীরের সুগার নিয়ন্ত্রণে GLP-1 Hormone এক বিরাট ভুমিকা পালন করে।
এখন কোন কারণে এই কার্যক্রম ব্যাহত হলে রক্তের Sugar বা Glucose লেভেল বেড়ে যায়। সেই অবস্থার নাম Hyperglycemia.
এবং এটাই প্রচলিত অর্থে ডায়াবেটিস নামে পরিচিত।
ডায়াবেটিস (Diabetes) কত প্রকার?
ডায়াবেটিস সাধারনত ৩ প্রকার। যথা-
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস (Type-1 diabetes),
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস (Type-2 diabetes) এবং
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational diabetes)
টাইপ-১ ডায়াবেটিস (Type-1 diabetes) কী?
Type 1 diabetes এ শরীরের Immuno system কোন এক অজানা কারণে Pancreas এর beta cell গুলোকে আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলে। ফলে Insulin উৎপাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কিছু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য।
কাজেই এই রোগীদেরকে দিনে কয়েকবার করে Insulin ইনজেকশন দেবার প্রয়োজন হয়।
অল্প বয়সের মানুষই সাধারণত এই রোগের রোগী। যদ্দুর জানা যায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা প্রায় ১০ জনের Type 1 ডায়াবেটিস।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস (Type-২ diabetes) কী?
Type 2 ডায়াবেটিসে রোগীর শরীরে Insulin তৈরি ঠিক থাকে, কিন্তু শরীরের কোষগুলো সেই Insulin এ সাড়া দেয় না বা দিতে পারেনা। এই অবস্থার নাম Insulin resistance. এর ফলে সুগার আর কোষে প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে তা রক্তে জমা হতে থাকে। এবং রক্তে সুগার লেভেল বেড়ে যায়।
এখন রক্তে সুগার লেভেল যত বাড়ে, Intestine তত বেশি GLP-1 hormone নিঃসরণ করে, আর যত বেশি GLP-1 নিঃসৃত হয় ওদিকে Pancreas তত বেশী Insulin উৎপন্ন করে।
এই অধিক Insulin এর কারণে রোগীর কোষগুলো তখন আবার সুগার গ্রহণ করতে পারে। অনেকটা আজকালকার ব্রয়লার মুরগির বাজারের মত, আগে যেখানে ১ কেজি ১৩০ টাকায় পাওয়া যেত এখন সেখানে লাগছে ২৮০ বা ৩০০ টাকা! অর্থাৎ আগে যেখানে একটা কোষকে ওপেন করতে ১ টা ইনসুলিন লাগত সেখানে এখন লাগছে ১০ টা!
Pancreas এভাবে কিছুদিন Overtime কাজ করে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট হয়। একারণে প্রাথমিক পর্যায়ে আসন্ন Type 2 ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ লেভেল স্বাভাবিক থাকে।
…কিন্তু কত আর কুলোয়! Pancreas ও ত একটা Live part of body! কাজেই সে একসময় দূর্বল হয়ে পড়ে, এবং তার উৎপাদন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে।
এভাবেই তৈরি হয় Type 2 ডায়াবেটিক পেশেন্ট।
মোট ডায়াবেটিস রোগীর প্রায় ৯০℅ ই এই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational diabetes) কাকে বলে?
এটা কেবল এবং কেবলমাত্র মহিলাদের অসুখ। কারণ এটা কেবল গর্ভাবস্থায়ই কিছু শরীরবৃত্তীয় কারণে হয়ে থাকে। আর এ কারণেই এর নাম গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা Gestational diabetes.
কখন আপনি ধারণা করবেন যে আপনি বা আপনার রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?
চলুন সরাসরি লক্ষণ না বলে ঘটনাগুলো গোড়া থেকে পর্যালোচনা করা যাক।
…আগের পর্বেই বলেছিলাম ডায়াবেটিসে ইনসুলিন তৈরি পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ হওয়ার কারণে কিংবা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স হওয়ার কারণে রক্তের সুগার বা গ্লুকোজ শরীরের কোষগুলো গ্রহণ করতে পারেনা।
তাহলে এর ফলে কোষগুলো শক্তি তৈরি করতে পারবেনা। যে কারণে রোগী দূর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব করবে।
এখন আমাদের শরীরের একটি সাধারণ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে যে, আমাদের শরীরে যখন ঘাটতি ঘটে তখন আমাদের ক্ষুধা অনুভূত হয় যাতে আমরা খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে সেই ঘাটতি পূরণ করি।
কাজেই এই রোগীর যেহেতু শক্তির ঘাটতি হচ্ছে সেহেতু সে ক্ষুধা অনুভব করবে। কিন্তু খাওয়ার পরেও ইনসুলিন এর অভাবে কোষগুলো গ্লুকোজ গ্রহণ করতে না পারার কারণে সে যতই খাবার খাক না কেন তার ক্ষুধা নিবারিত হবে না। ফলে কিছুক্ষণ পরপরই তার ক্ষুধা লাগবে এবং সে বারংবার খেতে থাকবে।
এদিকে কিডনির কাজ হচ্ছে রক্তকে ফিল্টার করে ভেতর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেওয়া। যেহেতু গ্লুকোজ শরীরের একটা প্রয়োজনীয় উপাদান সেহেতু কিডনি সেটাকে ফিল্টার করে রক্তে ফেরত পাঠায়।
এখন ডায়বেটিস রোগীর যেহেতু রক্ত গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে যায় সেহেতু একটা পর্যায়ে গিয়ে কিডনি আর সে ভার সামলাতে পারেনা। ফলে গ্লুকোজগুলোও প্রস্রাবের সাথে নির্গত হতে শুরু করে।
আর বাঁধ ভাঙলে ত কেবল পানিই ঢোকেনা, সাথে হাঙর কুমিরও ঢুকে পড়ে! একইভাবে কিডনি যখন অত্যাধিক গ্লুকোজের ভারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন গ্লুকোজের সাথে সাথে অন্যান্য প্রয়োজনীয় তরলও মূত্রের সাথে বের হওয়া শুরু করে।
ফলে একদিকে মূত্র এবং মূত্রত্যাগের পরিমাণ বেড়ে যায় অপরদিকে শরীরে তরলের ঘাটতির কারণে Physiological বা শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় রোগী পিপাসা বোধ করে। ফলে সে পানি পান করে। এভাবে যত পানি পান করে তত অধিক মূত্র তৈরি হয়। এভাবে রোগী বারবার মূত্রত্যাগ করে আর বারবার পানি পান করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না, ডিহাইড্রেট হওয়ার কারণে ত্বক, মুখগহ্বর, গলা শুষ্ক হয়ে যায়।
ওদিকে রক্তে গ্লুকোজ অধিক হওয়ার ফলে শরীরের কোষগুলো থেকে Osmosis প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত পানিও বেরিয়ে আসে। এভাবে নানান দিক দিয়ে ঘাটতি হওয়ার ফলে দ্রুত শরীরের ওজন কমতে থাকে।
আবার শরীরে তরলের ভারসাম্য না থাকায় চোখের লেন্সে ঠিকঠাক কজ করেনা, ফলে চোখে ঝাপসা দেখায়।
তাহলে আমরা ডায়াবেটিস (Diabetes) এর কী কী লক্ষণ পেলাম?
তাহলে আমরা কী কী লক্ষণ পেলাম?
১। শরীর দূর্বল এবং ক্লান্তি।
২। প্রচুর ক্ষুধা
৩। বারবার মূত্রত্যাগ
৪। প্রচুর পিপাসা
৫। দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
৬। ত্বক, মুখগহ্বর, গলগহ্বরেরশুষ্কতা।
৭। চোখে ঝাপসা দেখা।
এর সাথে আরো অনেক লক্ষণ যোগ হতে পারে যেমন ক্ষতস্থান সারতে দেরী হওয়া, হাতপা ঝিনঝিন করা বা অবস বোধ হওয়া, প্রভৃতি।
যাইহোক, এইসব লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে সন্দেহ করতে হবে এবং প্রয়োজনে গ্লুকোজ লেভেল পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে।
কী হবে ডায়াবেটিস এর রোগীর পরীক্ষা?
আমরা আগেই জেনেছি, ডায়াবেটিস মেলাইটাস Hyperglycemia’রই আরেক নাম। আর Hyperglycemia হচ্ছে এমন এক অবস্থা যাতে রক্তে চিনি বা গ্লুকোজ এর মাত্রা বেড়ে যায়।
তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে কিনা জানতে হলে আমাদেরকে দেখতে হবে রক্তের গ্লুকোজ এর মাত্রা বেড়েছে কিনা বা রোগীর Hyperglycemia হয়েছে কিনা।
আর কোন কিছু বেড়েছে কি কমেছে তা জানতে গেলে আমাদের জানতে হবে স্বাভাবিক অবস্থায় তা কী পরিমান থাকে।
রক্তের স্বাভাবিক গ্লুকোজ লেভেল কত?
গবেষণায় জানা যায়, রক্তের স্বাভাবিক গ্লুকোজ এর মাত্রা-
খালি পেটে- 70mg/dl থেকে 100mg/dl এবং
খাবার ২ ঘন্টা পর- 120mg/dl থেকে 140mg/dl.
এখানে,
mg/dl= ডেসিলিটার প্রতি মিলিগ্রাম
এছাড়াও অনেক রিপোর্টে মিলিগ্রাম পার ডেসিলিটার (mg/dl) এর বদলে মিলিমোল পার লিটার (mmol/l) ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে রক্তের স্বাভাবিক গ্লুকোজ এর মাত্রা-
খালি পেটে- 4mmol/l থেকে 6mmol/l. এবং
খাবার দুই ঘন্টা পর- 7.8 mmol/l এর কম।
এখানে,
mmol/l = লিটার প্রতি মিলি মোল
সুগার বা গ্লুকোজ লেভেল কত হলে প্রি-ডায়াবেটিক আর কত হলে ডায়াবেটিক?
এই গ্লুকোজ লেভেল খালি পেটে-
101mg/dl থেকে 125mg/dl হলে তবে প্রি-ডায়াবেটিক এবং
126 mg/dl বা আর চেয়ে বেশী হলে ডায়াবেটিক ধরা হয়।
আর খাবার ২ ঘন্টা পর গ্লুকোজ লেভেল-
140mg/dl থেকে 200mg/dl হলে প্রি-ডায়াবেটিক এবং
201mg/dl বা এর চেয়ে বেশি হলে ডায়াবেটিক ধরা হয়।
আর mmol/l (লিটার প্রতি মিলি মোল) স্কেলে গ্লুকোজ লেভেল
খালি পেটে-
6.1mmol/l থেকে 6.9mmol/l হলে প্রি-ডায়াবেটিক এবং
7.0 mmol/l বা তার অধিক হলে ডায়াবেটিক ধরা হয়।
আর খাবার ২ ঘন্টা পর গ্লুকোজ লেভেল-
7.8mmol/l থেক 11.1mmol/l হলে প্রি-ডায়াবেটিক এবং
11.1 mmol/l এর চেয়ে বেশি হলে ডায়াবেটিক ধরা হয়।
এসব নরমাল রেঞ্জ রিপোর্টেই উল্লেখ থাকে। তবে অনেক জায়গায় নাও থাকতে পারে। এজন্য আমাদের জানা থাকা জরুরি।
ডায়াবেটিস টেস্ট কী কী?
- Oral glucose tolerance test বা সংক্ষেপে OGTT
গ্লুকোজ লেভেল পরীক্ষা করতে বহুল ভাবে এবং সহজলভ্য ভাবে গ্লুকোমিটার ব্যবহার করা হয়। তবে ক্লিনিক্যালি রিলাইএবল টেস্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী করা হয়ে থাকে Oral glucose tolerance test বা সংক্ষেপে OGTT.
এতে রোগীকে খালি পেটে একবার ব্লাড স্যাম্পল নেওয়া হয় এরপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ৩০০ মিলি পানিতে গুলে খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পর আবার একবার ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে পরিমাপ করে দেখা হয় শরীর এই গ্লুকোজ কতটা absorb করতে পেরেছে আর কতটা রক্তে রয়ে গেছে। সেটাই খাবার ২ ঘন্টা পরের গ্লুকোজ লেভেল।
এরপর সেই লেভেল অনুযায়ী কোন সময় কোন অবস্থা বিবেচনা করতে হবে তা আগেই বলা হয়েছে।
- HbA1c.
আর একটা বহুল প্রচলিত টেস্ট এর নাম HbA1c.
কী এই পরীক্ষা?
আমরা জানি রক্তের লোহিত কণিকায় hemoglobin থাকে যা মূলত অক্সিজেন বহন করে। কিন্তু রক্তে glucose এর মাত্রা বেশী হলে hemoglobin glucose এর সাথে বন্ড তৈরি করে Glycated hemoglobin এ পরিণত হয়।HbA1c test মূলত এই glycated hemoglobin মোট hemoglobin এর শতকরা কত ভাগ তা নির্ণয় করার পরীক্ষা।
পরীক্ষার ফলাফল 5.7% এর কম হলে estimated average glucose level (সংক্ষেপে eAG) 117 mg/dl বা 6.5 mmol/l এর কম অর্থাৎ স্বাভাবিক ধরা হয়।
পরীক্ষার ফলাফল 5.7% থেকে 6.5% হলে estimated average glucose level (eAG) 117 mg/dl থেকে 140 mg/dl বা 6.5 mmol/l থেকে 7.8 mmol/l অর্থাৎ prediabetic ধরা হয়।
পরীক্ষার ফলাফল 6.5% এর বেশি হলে estimated average glucose level (eAG) 140 mg/dl বা 7.8 mmol/l এর অধিক, অর্থাৎ ডায়াবেটিক ধরা হয়।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রচলিত ব্যবস্থাপনাঃ
…অ্যালোপ্যাাথিতে একটা কথা প্রচলিত আছে
Diabetes cannot yet be cured, but it can be managed!
কীভাবে তারা এটিকে ম্যানেজ করে?
আচ্ছা, মনে আছে ত প্রথম পর্বে কী লিখেছিলাম?
…আমরা খাবার গ্রহনের পর তার একটা অংশ যখন intestine এ এসে ভেঙে সুগারে পরিণত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে, তখন একই সময়ে আমাদের Intestine এর endocrine cell- Glucogon like peptide 1 বা সংক্ষেপে GLP-1 নামক এক ধরনের হরমন নিঃসরণ করে।
এই হরমোন আমাদের Pancreas এর Beta cell কে প্রয়োজনীয় Insulin উৎপাদন করতে উদ্দীপিত করে এবং Alfa cell কে glucogon হরমোন নিঃসরণ করতে বাধা দেয়।
Pancreas এর Alfa cell এ উৎপন্ন হওয়া এই Glucogon আমাদের Liver কে জমা থাকা গ্লুকোজ নিঃসরণ করতে উদ্দীপিত করে। এটা ঘটে আমরা যখন দীর্ঘ সময়, যেমন রাতে বা রোজা অবস্থায়, অনাহারে থাকি তখন শরীরের প্রয়োজনীয় সুগার বা গ্লুকোজের লেভেল ঠিক রাখার জন্য।
তাহলে GLP-1 একদিকে Insulin উৎপাদনে সাহায্য করছে যাতে রক্তের সুগার সেই Insulin এর সাহায্যে শরীরের কোষে প্রবেশ করে আর অন্যদিকে Glucogon উৎপাদনে বাঁধা দিচ্ছে যাতে সেই glucogon লিভারের সঞ্চিত সুগার রক্তে নির্গত হতে নির্দেশ না দিতে পারে।
এছাড়াও এই ইন্টেলিজেন্ট হরমোন আমাদের stomach খালি হওয়ার রেট এবং ক্ষুধাও কমিয়ে দেয়।
এভাবেই আমাদের শরীরের সুগার নিয়ন্ত্রণে GLP-1 Hormone এক বিরাট ভুমিকা পালন করে।
কিন্তু এই GLP-1 এর একটা শত্রু আমাদের শরীরের অভ্যন্তরেই লুকিয়ে আছে, যার নাম Dipeptidylpeptidase-4 বা সংক্ষেপে DPP-4. এটি মূলত একটি Enzyme যা আমাদের রক্তনালী বা Blood vessel এর endothelium থেকে উৎপন্ন হয়। শত্রুতা ত এখানে রূপক ভাবে ব্যবহার করলাম, DPP-4 আসলে GLP-1 এবং GIP নামক সমজাতীয় আরো একটি হরমোনের কার্যক্রম একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে বন্ধ করে দেয়। এটা সুস্থ স্বাভাবিক physiological বা শরীরবৃত্তীয় ব্যাপার। আর এভাবেই শরীরের কর্মকাণ্ডগুলো balanced হয়।
কিন্তু এখানে অ্যালোপ্যাথরা দেখল যদি শরীরে এমন কিছু Input করা যায় যা GLP-1 এর মতই কাজ করবে কিন্তু DPP-4 দ্বারা inactive হয়ে যাবেনা তাহলে Insulin production বৃদ্ধি পাবে। সেই প্রচেষ্টা থাকে আবিষ্কার হল GLP-1 receptor agonists.
এই ঔষধের গ্রুপগুলো হল-
Exenatide
Liraglutide
Albiglutide
Dulaglutide
Semaglutide
Taspoglutide প্রভৃতি.
আবার তারা দেখল, যদি এমন কিছু হয় যা DPP-4 এর কাজকেই block করে দিবে। তাহলেও পূর্বানুরূপ ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। সেই প্রচেষ্টার ফলাফল হল DPP-4 inhibitors, এরা DPP-4 এর কাজকে স্থগিত করে দেয়। ফলে DPP-4 আর GLP-1 বা GIP এর কাজকে স্থগিতাদেশ দিতে পারেনা। ফলে Insulin production বৃদ্ধি পায়।
এর গ্রুপগুলো হচ্ছে-
Sitagliptin
Saxagliptin
Linagliptin
Alogliptin
Tenegliptin
Vildagliptin
Gemigliptin প্রভৃতি।
এছাড়া insulin এর তাৎক্ষণিক ঘাটতি মেটাতে Insulin injection ত রইলই।
এভাবেই এবং সমজাতীয় আরো অন্যান্য ভাবে তারা Diabetes কে Manage করার চেষ্টা করছে।
এভাবে হয়ত সাময়িক ভাবে রোগটা managed বা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিন্তু সারছেনা।
আর এতে যে সারবে না তা ত আমরা লজিক্যালি দেখতেই পাচ্ছি। আর তারাও রাখঢাক না করে সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছে- “Diabetes cannot yet be cured, but it can be managed!”
মূলত এইভাবে molicular বা pathological level এ শারীরিক কর্মকান্ডের বিভিন্ন প্রভাবকগুলো কম-বেশি করে, কোথাও কোন কিছুর বাড়তি বা ঘাটতি হলে তাতে সমজাতীয় কিছু যোগ-বিয়োগ করে ব্যাপারটা সাময়িক ভাবে উপশম করা যায় বটে কিন্তু তাতে কোনভাবেই আরোগ্য প্রত্যাশা করা যায়না। একটু ঘাটাঘাটি করলে আমরা বিভিন্ন chemical medicine গুলোর কার্যকারিতা এরকমই প্রত্যক্ষ করব।
ডায়াবেটিসের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ
হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এলোপ্যাথিক সিস্টেম অনুযায়ী কাজ করেনা। তার কার্যক্রম আলাদা স্তরে, যার নাম dynamic level.
এই যে ডায়াবেটিস রোগী, তার insulin resistance হোক বা immune system দ্বারা pancreas এর Beta cell গুলো ধ্বংস হোক, সেসব কেন হল? এর গোড়া কোথায়? কোন রোগ শক্তির আক্রমণে জীবনীশক্তি এমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেল? —-হোমিওপ্যাথি সেখানে গিয়েই কাজ করে।
কিন্তু সে খোঁজ আমরা কী করে পাব?
…তার কেবল এবং কেবলমাত্র উপায় হচ্ছে sign & symptom.
উদাহরণ স্বরূপ ডাকাত দলের চার সদস্যের নাম যথাক্রমে ঝন্টু, মন্টু, ইন্টু আর পিন্টু। এর মধ্যে ঝন্টুর হাতে পাকা বাঁশের লাঠি থাকে, মন্টুর হাতে চাপাতি, ইন্টুর হাতে বর্ষা আর পিন্টুর হাতে পিস্তল।
এখন কোন একজন যদি এই ডাকাত দলের এক বা একাধিক সদস্যের হাতে মার খেয়ে আহত হয়ে আসে তবে ক্ষতস্থান দেখেই কিন্তু বুঝে নেয়া যায় কোন আঘাতটা ঝন্টুর, কোনটা মন্টুর, কিংবা কোনটা ইন্টুর বা পিন্টুর।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ডাকাত দলের লোকজন আর তাদের অস্ত্রপাতি ত দৃশ্যমান ব্যপার, কিন্তু রোগশক্তি ত অদৃশ্য, আর তা আক্রমণ করেও Dynamic লেভেলে, তাহলে এখানে আমরা ঝন্টু-মন্টু চিনে রাখব কী করে?
ঠিক এই জায়গাতেই হোমিওপ্যাথি অত্যন্ত লজিক্যাল, সহজবোধ্য, বিজ্ঞানসম্মত এবং অনন্য।
কীভাবে?
হোমিওপ্যাথি তার ঔষধসমূহকে ইঁদুর, গিনিপিগ বা এই জাতীয় কোন ইতর প্রাণীর ওপর পরীক্ষণ বা প্রুভিং না করে সরাসরি সুস্থ্য মানব দেহে প্রুভিং করে।
এতে ধরুন, A নামক একটি ঔষধ সুস্থ্য মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হলে তার মধ্যে ক,খ,গ,ঘ এবং ঙ লক্ষণ প্রকাশ পেল। ধরে নেয়া হল A ঔষধটি সেই ব্যক্তির জীবনীশক্তির x স্থানে আঘাত করেছে।
একই ভাবে আরো একটি ঔষধ B কে একটি সুস্থ্য মানুষে প্রয়োগ করা হলে তার মধ্যে চ,ছ,জ,ঝ এবং ঞ লক্ষণ প্রকাশ পেল। ধরে নেয়া হল B ঔষধটি সেই ব্যক্তির জীবনীশক্তির y স্থানে আঘাত করেছে।
একই ভাবে আরো একটি ঔষধ C কে সুস্থ্য মানুষে প্রয়োগ করে দেখা গেল তার মধ্যে ট,ঠ,ড,ঢ এবং ণ লক্ষণ প্রকাশ পেল। ধরে নেয়া হল C ঔষধটি সেই ব্যক্তির জীবনীশক্তির z স্থানে আঘাত করেছে।
এখন প্রাকৃতিক রোগে আক্রান্ত হয়ে কোন ব্যক্তি যদি ছ, জ এবং ঞ, এই তিনটি লক্ষণ নিয়ে আমাদের কাছে আসে তবে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে এই রোগীর জীবনীশক্তির y স্থান আক্রান্ত এবং সেই y স্থানকে আঘাত করতে পারে এমন কৃত্রিম ঔষধ শক্তির নাম B.
তাহলে এই রোগীকে আমরা B ঔষধটি শক্তিকৃত এবং সূক্ষ্মভাবে সেই রোগীতে প্রয়োগ করব।
কী হবে তাতে?
আমরা সকলেই একটা প্রাকৃতিক নিয়মের কথা জানি, তা হচ্ছে সদৃশ সদৃশকে বিকর্ষণ করে। তাহলে y স্থানে যখন আমাদের B ঔষধটি যাবে তখন সেখানে আগে থেকেই থাকা প্রাকৃতিক রোগ শক্তিটি তাকে বিকর্ষণ করবে। কিন্তু যেহেতু ঔষধজ শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী বারবার প্রয়োগ করে এবং শক্তি পরিবর্তন করে শক্তিশালী থেকে আরো শক্তিশালী করা যায় সেহেতু একসময় প্রাকৃতিক রোগটি ঔষধ সৃষ্ট কৃত্রিম রোগের কাছে পরাজিত ও বিতাড়িত হয়।
পরবর্তীতে স্বল্পক্রিয় হওয়ায় এবং জীবনীশক্তির আরোগ্যপ্রবণতার ক্রিয়ায় ঔষধজ রোগটিও সময়ের সাথে সাথে একসময় শেষ হয়ে যায়।
এইভাবে হাজার হাজার প্রুভিং করা ঔষধের নাম এবং তাদের প্রুভিং লক্ষণসমূহকে হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা নামক গ্রন্থে লিখে রাখা হয়েছে।
রোগী প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণ নিয়ে হোমিওপ্যাথদের কাছে এলে তারা তাদের মেটেরিয়া মেডিকা থেকে সেই প্রাকৃতিক রোগের সদৃশ্য লক্ষণ সৃষ্টিকারী ঔষধটি তাকে প্রয়োগ করে। এটাই হোমিওপ্যাথি।
তাহলে ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাটা কেমন হবে?
…একই রকম। কেবল ডায়াবেটিস কেন, জানা অজানা সকল রোগের রোগীর ক্ষেত্রেই নিয়ম এই একটাই।
এখানে উল্লেখ্য যে রক্তে গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে যাওয়া কিন্তু একটা খুবই সাধারণ প্যাথলজিক্যাল বিষয়, ঔষধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন রোগীতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হতে পারে। সেগুলোকে খুবই সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেই সদৃশ্যতম ঔষধটি নির্বাচন করতে হয়।
অনেক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডায়াবেটিস রোগীতে Syzygium jambolanum এবং Abroma augusta ঔষধ দুটোর মাদার টিংচার গড়পড়তাভাবে ব্যবহার করেন। তাদের মতে এতে সুগার লেভেল দ্রুত কমে যায়। আমিও আমার চিকিৎসা জীবনের শুরুর দিকে তাদের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে এই ঔষধগুলো ব্যবহার করে দেখেছি। কিন্তু কোন ফলপ্রসূ ফলাফল পরিলক্ষিত হয়নি। কাজেই আমি ওসব ছেড়ে কেবলমাত্র সদৃশ্য শক্তিকৃত ঔষধই ব্যবহার করছি এবং সেটাই যথারীতি যথার্থ বলে প্রমাণিত হচ্ছে।