একজন জানতে চেয়েছিলেন “সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার পরেও কেন রোগ আরোগ্য হয় না?”
আজকের আর্টিকেলের অবতারনা মূলত এই প্রশ্নের প্রেক্ষাপটেই।
সিঙ্গেল মেডিসিন প্রেসক্রাইব করা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার একটা অন্যতম শর্ত বটে কিন্তু এটাই একমাত্র শর্ত নয়। হোমিওপ্যাথিতে রোগ আরোগ্য হওয়া না হওয়ার পেছনে বেশকিছু ফ্যাক্ট রয়েছে। সেগুলোকে আমরা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম কানুন হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।
তবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম-কানুন গুলো আলোচনা করার আগে আমরা সংক্ষেপে সিঙ্গেল মেডিসিন সম্পর্কে জেনে নিব। কারণ আমার অনেক পাঠকই হয়ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কে জানলেও সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ব্যাপারে ইতোপূর্বে কম শুনে থাকবেন।
সিঙ্গেল মেডিসিন (Single medicine) কী?
ইংরেজি সিঙ্গেল(single) শব্দের অর্থ একক বা একটি আর মেডিসিন (medicine) শব্দের অর্থ ঔষধ। তাহলে সিঙ্গেল মেডিসিন এর শব্দগত অর্থ দাঁড়াচ্ছে একক ঔষধ বা একটি মাত্র ঔষধ।
একটা রোগীর মধ্যে নানান ধরনের রোগ লক্ষণ একই সময়ে উপস্থিত থাকতে পারে। এলোপ্যাথিক নিয়ম অনুযায়ী সেই সমস্ত রোগ লক্ষণগুলোর মধ্য থেকে একটি বা কয়েকটি কে নিয়ে একটি করে রোগের নামকরণ করা হয়। এবং সর্বশেষে দেখা যায় যে একটা রোগীর মধ্যে একই সময়ে ২-৪-৫ এমনকি ১০ টা রোগও উপস্থিত থাকে। যেমন একটা রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, একই সময়ে তার আবার হার্টে ব্লক, হাই প্রেসার, কিডনিতে পাথর, ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস বি পজেটিভ, হাইড্রোনেফ্রোসিস, ক্রনিক টনসিলাইটিস, মাইগ্রেন, ওসিডি, ক্রনিক এনাল ফিসার ইত্যাদি। তাহলে একই সাথে তার কতগুলো রোগ!
এলোপিতিতে এই সমস্ত রোগের নাম আলাদা এবং ঔষধও আলাদা আলাদা। কেবল আলাদা আলাদা ঔষধই নয় এই সমস্ত রোগের চিকিৎসার জন্য ওই রোগীকে ডায়াবেটিস হাসপাতাল, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, হেপাটলজিস্ট, কিডনি স্পেশালিস্ট, সাইক্রিয়াট, নিউরোলজিস্ট সহ বেশ কয়েকটা বিভাগের ডক্টরের কাছে দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতে হবে। ফলে একই রোগীকে একই সময়ে হয়তো চার-পাঁচটা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হবে এবং দিনে হয়তো ১৫-২০ টা করে ওষুধ খেতে হবে।
কিন্তু হোমিওপ্যাথিক কনসেপ্ট এখানে আলাদা। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতি অনুযায়ী এখানে রোগী একজন সুতরাং রোগীর এই সমস্ত রোগ লক্ষণ একটার সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। কাজেই সমস্ত রোগ লক্ষণগুলোকে আমলে নিয়ে রোগীর অন্যান্য শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণের সঙ্গে এভালুয়েট করে রোগীকে এক সময়ে একটি মাত্র ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। এটাই হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সিঙ্গেল মেডিসিন।
আর এই নিয়মের কারণেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা দাবি করে যে তারা রোগের নয় রোগীর চিকিৎসা করে। কারণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম অনুযায়ী তারা কোন নির্দিষ্ট রোগের জন্য ঔষধ নির্বাচন করে না বরং সেই রোগে বা রোগ সমূহে আক্রান্ত রোগীর জন্য ওষুধ নির্বাচন করে।
এখানে উল্লেখ্য যে সিঙ্গেল মেডিসিন মানে এই নয় যে এটা সেই রোগীর জন্য একেবারেই ধ্রুব সত্য, তার আর পরিবর্তন নেই। এক ঔষধেই রোগীর জীবন পার!
সেকেন্ড ভিজিটে রোগীর পরিবর্তিত অবস্থা অনুযায়ী নতুন মেডিসিন নির্বাচিত হতে পারে এবং সেটিই হবে সেই সময়ের সিঙ্গেল মেডিসিন। এভাবে একটা ক্রনিক রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন প্রয়োজনে ২-৪-৫ এমনকি ১০-২০ টা ঔষধও পরিবর্তন করার দরকার হতে পারে।
যাই হোক এতক্ষণে সম্ভবত আমি সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে আমার পাঠকদেরকে একটা ভালো ধারণা দিতে পেরেছি। তাহলে চলুন এবার সামগ্রিক ভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম কানুন সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম বা ধাপ সমূহ
একক ঔষধ বা সিঙ্গেল মেডিসিন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার একটা অপরিহার্য বিষয়। তবে সেই চিকিৎসাটা কিছু নির্দিষ্ট ধাপ মেইনটেইন করে করতে হয়। চলুন এখন সেই ধাপগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।
প্রোপার কেস টেকিং
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে কেস টেকিং অর্থাৎ রোগীর রোগলক্ষণ এবং রোগীর অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া হচ্ছে সবথেকে প্রধান এবং অন্যতম ব্যাপার। গুরুত্ব বোঝাতে গেলে আমরা বলতে পারি যে একটা চিকিৎসার শতকরা ৯০ ভাগই হচ্ছে এই কেস টেকিং। এখানে তথ্য সংগ্রহ করতে যদি কোন চিকিৎসক ভুল করেন তাহলে সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ অর্থাৎ সঠিকভাবে সিঙ্গেল মেডিসিন নির্বাচন সহ পরবর্তীতে প্রত্যেকটা পদক্ষেপেই ভুল হবে ফলে রোগী আরোগ্যের দিকে না গিয়ে বরং আরো জটিলতার দিকে ধাবিত হবে।
সিম্পটম এভালুয়েশন
কেইস টেকিং এর সময় আমরা একটা রোগীর কাছ থেকে বহু ধরনের সিম্পটম পেয়ে থাকি যার সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সব সিম্পটম ওষুধ নির্বাচন করতে সহায়তাও করে না। যাচাই-বাছাই করে সেই সমস্ত অপ্রধান এবং অগুরুত্বপূর্ণ লক্ষণসমূহ বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্বপূর্ণ, যাদেরকে হোমিওপ্যাথির মূল গ্রন্থ অর্গানন অফ মেডিসিন এর ভাষায় রেয়ার, আনকমন, পিকিউলিয়ার অ্যান্ড স্ট্রাইকিং (Rear, uncommon, peculiar and striking) সিম্পটম হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাদেরকে আলাদাভাবে একত্রিত করাটাকেই এভালুয়েশন অফ সিম্পটম বলা হয়।
কোন চিকিৎসক যদি তার প্রজ্ঞা এবং মেধা দিয়ে এ ব্যাপারটা সুন্দরভাবে করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সঠিকভাবে সিঙ্গেল মেডিসিন নির্বাচন সহ পরবর্তী পদক্ষেপগুলো ভুল হবে এবং রোগ আরোগ্য হবে না অর্থাৎ রোগী সুস্থ হবে না।
সিমিলিমাম মেডিসিন
এই সিমিলিমাম মেডিসিনটিই মূলত আমাদের সেই সিঙ্গেল মেডিসিন। মেডিসিন নির্বাচনের এই ধাপটাকে আমরা রেপার্টরীকরণ নামেও অভিহিত করতে পারি। সিমটম এভালুয়েশনের এর মাধ্যমে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ সিম্পটম গুলোর সবগুলো সিম্পটমকে কভার করে এমন মেডিসিনের সংখ্যা বহু হতে পারে। তবে এমন পরিস্থিতি সাধারণত খুব কমই ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন মেডিসিনই সবগুলো সিম্পটমকে কভার করে না। হয়তো দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ দশটা সিম্পটমের মধ্যে হতে কোন মেডিসিন ৭ টা, কোন মেডিসিন ৮ টা, কোন মেডিসিন ৬ টা, আবার কোন মেডিসিন হয়তো ৯ টা সিমটমকে কভার করছে।
এরকম পরিস্থিতিতে আমাদেরকে বিবেচনায় আনতে হবে যে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিম্পটমটিকে অথবা সিমটম গুলোকে কোন মেডিসিনটি কভার করছে। এসব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ৯ টা সিম্পটমকে কভার করছে বলেই যে সেই মেডিসিনটাকে আমাদের প্রেসক্রিপশন করতে হবে এমন কোন কথা নেই, হয়তো দেখা যাচ্ছে যে ওই মেডিসিনটিতে যে একটিমাত্র সিম্পটম বাদ পড়ছে সেটাই হচ্ছে ওই রোগীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈশিষ্ট্যমন্ডিত সিম্পটম, যাকে আমরা প্রিডোমিনেটিং সিম্পটম (predominating Symptom) বলে আখ্যায়িত করি।
কাজেই সিমিলিমাম মেডিসিন নির্বাচন করাটাও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়মের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোন কোন চিকিৎসক তাদের স্বল্প অভিজ্ঞতার কারনে বা জ্ঞানের অভাবের কারণে বেশিরভাগ রুবরিক বা সিম্পটম কভার করা মেডিসিনটাকেই সিঙ্গেল মেডিসিন হিসেবে প্রেসক্রিপশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে করে অনেক সময় সেই রোগীর প্রিডোমিনেটিং সিম্পটমটাই হয়তো বাদ পড়ে যায় ফলে আরোগ্যক্রিয়া বিলম্বিত, প্রলম্বিত অথবা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
রাইট পোটেন্সি
সিমিলিমাম সিঙ্গেল মেডিসিনটি নির্বাচনের পরেই আসে সেই মেডিসিনটি রোগীকে কোন পোটেন্সি বা শক্তিতে প্রয়োগ করা হবে সেটা বিবেচনার পালা। উপরের সমস্ত ধাপগুলো সঠিকভাবে এবং সফলতার সাথে পার করে আসার পরেও কেউ যদি সঠিক শক্তি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয় তবে সেই চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী আরোগ্য করতে ব্যর্থ হতে পারে।
অভিজ্ঞতায় দেখা যায় প্রয়োজনীয় শক্তির থেকে কম শক্তিতে প্রয়োগ করা হলে সেই মেডিসিন রোগীর মধ্যে যথেষ্ট ক্রিয়া প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় না। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তিতে প্রয়োগ করা হলে অহেতুক রোগবৃদ্ধি, রোগীর কষ্ট এমনকি অনেক সময় জীবন সংশয় হয়ে পড়তে পারে।
রাইট ডোজ
সঠিক ঔষধ কেবল রাইট পোটেন্সিতে প্রয়োগ করলে হবে না ঔষধটার রাইট ডোজ ও নির্ধারণ করতে হবে বিচক্ষণতার সাথে।
ডোজ বা মাত্রা হচ্ছে রোগীকে একবারে কতটুকু ওষুধ দেওয়া হবে, সেই পরিমাণ ওষুধ রোগীকে কত সময় পর পর কতবার দেওয়া হবে সেই সমস্ত হিসাব নিকাশ।
প্রয়োজনীয় মাত্রার অভাবে মেডিসিন যেমন ক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয় তেমনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাত্রার ফলে রোগীর অহেতুক রোগবৃদ্ধি সহ নানান ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। যাকে আমরা ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও বলতে পারি।
মনে রাখতে হবে, ওষুধ প্রয়োগের পর চলমান রোগের বৃদ্ধি হলে তাকে ঔষধজ বৃদ্ধি বলা হয় আর যদি নতুন কোন সিম্পটম উৎপন্ন হয়, বা নতুন রোগ দেখা দেয় তাহলে তাকে আমরা ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বলতে পারি।
কাজেই হোমিওপ্যাথিতে যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না এই প্রচলিত কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। ওষুধ স্থূলমাত্রায় যদি বারবার অহেতুক প্রয়োগ করা হয় তাহলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঔষধ সঠিক হলেও এই ধরনের প্রয়োগে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আর ভুল ঔষধ হলে তো কথাই নেই!
কোয়ালিটিফুল মেডিসিন
একজন যোদ্ধার অস্ত্র যেমন তার তরবারি বা বন্দুক-রাইফেল, তেমনি একজন চিকিৎসকের অস্ত্র হচ্ছে তার ঔষধ।
কাজেই যার অস্ত্র যত ধারবিহীন হবে অর্থাৎ কোয়ালিটিহীন হবে তার যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা ততই কম হবে।
সুতরাং কেবলমাত্র সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতির জন্য যথেষ্ট নয়, আরোগ্য ক্রিয়ায় ওষুধের কোয়ালিটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কম্প্রোমাইজের কোন সুযোগ নেই।
এডভাইসিং
অনেক রোগী মনে করে যে কেবল ওষুধ খেলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব। এমনকি অনেক চিকিৎসকও শুধুমাত্র ঔষধ দিয়েই রোগীকে সুস্থ করতে চান।
কিন্তু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম অনুযায়ী আরোগ্যের ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। রোগী সুস্থ্য করতে হলে রোগীকে রোগবৃদ্ধি হওয়ার পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজনে তাকে তার আহার-বিহার এবং জীবন যাপন রীতিতে, এমনকি তার কর্মস্থল বা বাসস্থানেও পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।
কিন্তু অনেক তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কেবলমাত্র বাঁধাগতে কিছু খাদ্য খাবারে নিষেধাজ্ঞার একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া রোগীকে তেমন কোন পরামর্শই দেন না। ফলে এত খাটাখাটনি করে সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেও প্রকৃত আরোগ্য আসতে অনেক সময় লাগে, এমনকি অনেক সময় তা অসম্ভবও হয়ে পড়ে।
মনিটরিং
চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতি মেনে সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করলেন এবং রোগীকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন দরকারি পরামর্শ দিলেন আর রোগী তা দৈব বাণী মনে করে অক্ষরে অক্ষরে পালন করল এমনটা ভাবা কিন্তু মোটেও সমীচীন নয়।
আমরা আমাদের প্রাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স-এ দেখতে পাই রোগী বড়জোর নিয়ম করে ঔষধ গুলো খায়, কিন্তু তাকে দেওয়া অন্যান্য পরামর্শ বা উপদেশগুলোর অধিকাংশই, এমন কি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবগুলোই অবহেলা করে বা পালন করে না। অনেক সময় তো অনেকে নিয়ম করে ওষুধগুলোও ঠিক মত খায় না।
রোগ আরোগ্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এইসব নিয়ম-কানুন, আদেশ উপদেশ বা পরামর্শের ধার না ধারলেও সেকেন্ড ভিজিটে এসে রোগী কিংবা রোগীর অভিভাবকদের চিকিৎসকের যোগ্যতা এবং ঔষধের গুণগত মান নিয়ে অনুযোগের শেষ থাকে না!
এমন পরিস্থিতিতে অনেক চিকিৎসকই আশানূরুপ ফলাফল না পেয়ে তাদের নির্বাচিত সিঙ্গেল মেডিসিনটি সঠিক নয় বলে মনে করে এবং ওষুধ পরিবর্তন করে দ্বিতীয় কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতির দিকে তাকালে হয়তো দেখা যাবে যে তার পূর্বনির্বাচিত সিঙ্গেল মেডিসিনটিই সঠিক ছিল। কিন্তু রোগী বা রোগীপক্ষের ভুলের কারণেই সে এখানে মিস-গাইডেড হয়ে গেল।
সুতরাং সঠিকভাবে রোগী আরোগ্য করতে হলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতি মেনে কেবল একটিমাত্র সিঙ্গেল মেডিসিন নির্বাচন করে এবং রোগীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েই দায়িত্ব শেষ নয়। রোগী তাকে দেওয়া পরামর্শ এবং নিয়মকানুন গুলো ঠিকঠাক ভাবে ফলো করছে কিনা সেটাও মনিটরিং করতে হবে।
আমি আবার এটা বলতে চাচ্ছি না যে রোগীর পেছনে গোয়েন্দা লাগাতে হবে। তবে রোগী এসে যখন বলবে যে ওষুধ ঠিকঠাক ভাবে কাজ করেনি তখন তার কাছ থেকে বা তাদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে যে তাকে যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সে ঠিকঠাক ভাবে পালন করেছে কিনা। যদি ঠিকঠাকভাবে পালন না করে থাকে তাহলে ঔষধ পরিবর্তনের আগে রোগীর এবং রোগীর অভিভাবকদেরকে নিয়ম-কানুন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ গুলো মেনে চলার জন্য তাগিদ দিতে হবে।
কাউন্সিলিং
মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই, এমনকি অন্যান্য রোগের রোগীদের মধ্যেও প্রায়ই দেখা যায় তাদের রোগ সম্পর্কে নানান ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার বিদ্যমান থাকে। এমনকি জীবনের অন্যান্য স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়েও বহু ভুল ধারণা এবং কুসংস্কারের মধ্যে ডুবে থাকে অনেকে। এগুলো তাদের ভেতর অহেতুক দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং হতাশা সৃষ্টি করে। ফলে আরোগ্যের স্বাভাবিক গতি ত ব্যাহত হয়ই এমনকি এই সমস্ত ভুল ধারণা প্রসূত দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ এবং হতাশাজনিত কারণে তাদের রোগ প্রায়ই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।
সুতরাং এই সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক যদি কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে তাদের যাবতীয় ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার দূর করে দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান না করতে পারেন তবে একটা সিঙ্গেল মেডিসিন প্রয়োগ করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আজীবন করে গেলেও প্রকৃত রোগ আরোগ্যর প্রত্যাশা সত্যিই অবান্তর; তাতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যতই সুনির্বাচিত হোক না কেন।
ফলোআপ
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করার অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগের পরবর্তী সময়ে রোগীকে ফলোআপ করা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
রোগীতে নির্বাচিত সিঙ্গেল মেডিসিন অর্থাৎ একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগের পর অনেক রকমের অবস্থা তৈরি হতে পারে। যেমন- রোগ বাড়তে পারে, কমতে পারে, আবার অপরিবর্তিতও থাকতে পারে। এগুলোর আবার বিভিন্ন ভেরিয়েশনও হতে পারে, যেমন- রোগ বেড়ে কমতে পারে, কমে গিয়ে বাড়তে পারে, কমে গিয়ে আবার আগের জায়গায় চলে আসতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম কম বেশি ১২ থেকে ২১ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে পারে। তখন অনেক সময় ঔষধ পরিবর্তন করতে হয় অথবা ওষুধের পাওয়ার বাড়াতে হয় এমনকি কমাতে হয় বা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নিয়ম অনুযায়ী ওষুধের ডোজ বা মাত্রা বাড়াতে বা কমাতে হতে পারে। অর্থাৎ এক কথায় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়।
কাজেই ওষুধ প্রয়োগ করার পরই চিকিৎসকের দায়িত্ব শেষ নয়। রোগীকে ভালোভাবে ফলোআপ বা পর্যবেক্ষণ করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে যতই সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করি না কেন, রোগ আরোগ্যের প্রকৃত প্রত্যাশা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারিনা।
সেকেন্ড প্রেস্ক্রিপশন
এটা মূলত ফলোআপেরই শেষ ধাপ। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঠিক নিয়ম নীতি অনুসরণ করে ঔষধ প্রয়োগের পরবর্তী অবস্থা ফলোআপ বা পর্যবেক্ষণ করে রোগীর জন্য সঠিক ব্যাবস্থা প্রদান করাই সেকেন্ড প্রেসক্রিপশন। প্রথম প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রের পরবর্তী সকল প্রেসক্রিপশনই সেকেন্ড প্রেসক্রিপশন হিসেবে পরিগনিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নিয়ম নীতি মেনে একবারে একটি মাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ অর্থাৎ সিঙ্গেল মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রথম প্রেসক্রিপশন সঠিক হয়। কিন্তু তারপরও অধিকাংশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগ আরোগ্য করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ হচ্ছে এই সেকেন্ড প্রেসক্রিপশন বা দ্বিতীয় ব্যবস্থাপত্রে ভুল করা।
...শেষ কথা
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সফলতা পেতে হলে কেবলমাত্র সিঙ্গেল মেডিসিন নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয় বরং উপরের দশটি ধাপের প্রত্যেকটিই সফলতার সাথে অতিক্রম করতে হবে। তবেই একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সত্যিকার অর্থে রোগ আরোগ্যে সফল হবেন।
মনে রাখতে হবে একসঙ্গে একটার বেশি ঔষধ প্রয়োগ করা চিকিৎসক কোনোভাবেই নির্ভরযোগ্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নয়। ভালো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক চেনার উপায় নিয়ে আমি আগে একটা আর্টিকেল পোস্ট করেছিলাম। এ ব্যাপারে সেখানে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। কেউ সেটা পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।